মোঃ আলমগীর হোসেন,লোহাগড়া (নড়াইল)প্রতিনিধি// নড়াইলের ভদ্রবিলা ইউনিয়নের রামসিদ্ধি ও ডহর রামসিদ্ধি পাশাপশি দু’টি গ্রাম। এই রামসিদ্ধি ও ডহর রামসিদ্ধি গ্রামেই তৈরি হয় কাঠের নৌকা। বিক্রিও হয় ওই গ্রামেই ।গ্রাম দু’টি নৌকার গ্রাম হিসেবে পরিচিত। প্রতি বুধবার বসে নৌকার হাট। সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত চলে বেচাকেনা।
প্রতি হাটে গড়ে ৮০ থেকে ১০০টি নৌকা বিক্রি হয়। প্রতিটি নৌকার দাম সাড়ে চার হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা। সম্প্রতি ভোরে হাটে গিয়ে দেখা যায়, ১৩৭ নম্বর ডহর রামসিদ্ধি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনে রাস্তার পাশে প্রায় শ’খানেক নৌকা রাখা আছে বিক্রির জন্য। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রেতারা এসেছেন নৌকা কিনতে। এ ছাড়া রয়েছেন নৌকা ব্যবসায়ীরা। এখান থেকে সস্তায় নৌকা কিনে নিয়ে আশপাশের জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বেশি দামে নৌকা বিক্রি করে থাকেন তারা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ এলাকায় এখন মোট ১৬টি পরিবার নৌকা তৈরির কাজ করে। প্রতিটি কারখানায় তিন থেকে পাঁচজন কারিগর কাজ করেন। শনি থেকে মঙ্গলবার এ পাঁচদিনে একেকটি কারখানায় সাধারণ মানের পাঁচ/ছয়টি নৌকা তৈরি হয়। এখানে তৈরি হয় টালাই, আলকাটা পানসি,পইদেল জেলে ডিঙ্গি ইত্যাদি।অনেক সময় ক্রেতা সরাসরি অর্ডার দিয়ে তাদের চাহিদা মতো নৌকা তৈরি করিয়ে নেন। সে ক্ষেত্রে নৌকার সাইজ ও কাঠের ধরনের ওপর নির্ভর করে একটি নৌকা বানাতে পাঁচ/১০ দিন সময় লেগে যায়। দাম পড়ে ১৫ হাজার থেকে শুরু করে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
বর্ষাকালের দুই মাস আগে থেকে শুরু করে ভাদ্র-আশ্বিন মাস পর্যন্ত চলে নৌকা তৈরির কাজ। তবে এবার বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি কম হওয়ায় বিলে পর্যাপ্ত পানি নেই। সে কারণে নৌকার চাহিদা অন্য বছরের তুলনায় অনেক কম বলে জানিয়েছেন তারা।
কথা হলো অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শ্রী রবিন্দ্রনাথ বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, কমপক্ষে দেড়শ’ বছর আগে থেকে আমাদের পরিবার নৌকা বানিয়ে আসছে। ঠাকুরদা মৃত অভয় চরণ বিশ্বাস শিখেছিলেন তার বাবার কাছ থেকে। এরপর ঠাকুরদার কাছ থেকে শিখে বাবা মৃত রাজেন্দ্র নাথ বিশ্বাসও একই কাজ করতেন। তাদের থেকে আমিও শিখেছি নৌকা তৈরি। ছাত্রাবস্থায় এ কাজ করতাম। বর্তমানে আমার ভাই এ ব্যবসা দেখাশোনা করছেন।
নৌকা তৈরির কারখানার মালিক ডহর রামসিদ্ধি গ্রামের হরেন বিশ্বাস জানান, তিনি গত বছরও প্রতি হাটে সাত/আটটি নৌকা বিক্রি করতেন। কিন্তু এবার বিলে বেশি পানি না থাকায় চার/পাঁচটির বেশি বিক্রি করতে পারছেন না। এছাড়া কাঠের দাম বৃদ্ধি ও এ কাজে ব্যবহৃত লোহার পাতামের (নৌকা তৈরিতে প্রয়োজনীয় উপকরণ)দাম বাড়ায় নৌকা বিক্রি করে তেমন লাভও হচ্ছে না।
যশোর জেলার অভয়নগর থানার চন্দ্রপুর গ্রামের নৌকা ব্যবসায়ী জাবেদ শেখ বলেন, আমি এখান থেকে প্রতি হাটে ছয়টি করে নৌকা কিনি। এলাকায় নিয়ে বিক্রি করে আমার নৌকা প্রতি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা লাভ হয়।
কালিয়া উপজেলার ফুলদাহ গ্রামের ক্রেতা রুকু ফকির জানান, তিনি পাঁচ হাজার টাকা করে একটি টালাই ও একটি পইদেল নৌকা কিনেছেন। গতবারের তুলনায় এবার দাম বেশি।এসব মানের নৌকা গতবছর তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় পাওয়া যেত।
নৌকা বিক্রেতা ডহর রামসিদ্ধি গ্রামের শুশিয়ান মল্লিক জানান, তিনি পাঁচটি নৌকা এনেছিলেন হাটে। চারটি বিক্রি করেছেন। একটি বিক্রি না হওয়ায় এখানে রেখে যাবেন। পানি কম হওয়ায় ভরা মৌসুমেও এবার নৌকার চাহিদা কম।
কারিগর শ্রীকান্ত বিশ্বাস বলেন, একটি টালাই বা পইদেল নৌকা বানাতে সাত থেকে আট সিএফটি কাঠ লাগে। তিনজন মিলে কাজ করলে একটি নৌকা বানাতে একদিন সময় লাগে। একজন কারিগরের দৈনিক মজুরি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা আর সহকারীর মজুরি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। গত প্রায় ৩০ বছর ধরে এখানে নৌকার হাট বসলেও নেই কোনো সরকারি তদারকি বা ইজারার ব্যবস্থা। গ্রামবাসী মিলে একটা কমিটি করে দিয়েছে। সেখান থেকে ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে রশিদের মাধ্যমে টাকা তোলেন হরেন বিশ্বাস নামে একজন। তিনি জানান, সাধারণ ক্রেতার কাছ থেকে নৌকা প্রতি ১০০ টাকা ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ৫০ টাকা করে নেওয়া হয়। এ টাকা স্থানীয় মন্দির ও সারা বছর ধরে এখানকার ধর্মীয় কাজে ব্যয় করা হয়।
নড়াইল বিসিক-এর উপব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সোলায়মান হোসেন বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে। এ শিল্পের উন্নয়নের জন্য যা যা করা দরকার করা হবে।
Leave a Reply